Saturday, October 19, 2013

অধরা দশমী



নবমীর সাতসকালে হাওয়ায় পুজো পুজো গন্ধ, দূর থেকে ভেসে আসা ঢাকের মৃদু শব্দ, সবই ছিল। ছিল না শুধু রঙীন কাপড়ে-আলোতে মোড়া ফটক। বদলে, বিরাট কাঠের দরজার দু’পাশে রাখা মঙ্গলঘট। ঠিকানাটা মিলছে যখন, ঢুকে পড়লাম। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই একটু এগিয়ে থমকে যেতে হ’ল অপ্রত্যাশিত জানলার সামনে। গরাদের ফাঁক দিয়েই প্রথম দর্শন দিলেন পটলডাঙ্গার বসুমল্লিকবাড়ীর একচালা দুর্গাঠাকুর। নিকন-ক্যানন যার যা ছিল... খচাৎ উঠল ছবি। আবার খচাৎ... ছবি তোলার ছবি।
গলি পেরিয়ে, উঠোন পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ঠাকুরদালানে। লোক বলতে শান্ত হাতে পুজোর প্রস্তুতিতে মগ্ন পুরোহিত, লাল শাড়ী পরা ষাটোর্ধ্বা এক মহিলা, শ্বেতবসনা অশীতিপর এক বৃদ্ধা, আর আমরা তিনজন। লাল শাড়ী পরে কুমারীপুজোর কুমারী সাজতে বসেছে। ডিজিটাল যুগের কুমারীর সাজগোজের থালায় ফেসপাওডার, টিপ, চন্দন, আলতার পর সবশেষে আইলাইনার। আই মেক-আপ এক্সপার্ট হিসেবে তাই মোবাইলে ডাক পড়ল পরের প্রজন্মের। তেরো-চোদ্দ বছরের একটি মেয়ে এসে নিপুণ হাতে বুলিয়ে দিল শেষ প্রলেপ। এদিকে প্রসাধনের বিভিন্ন তুলির সুড়সুড়িতে মাঝেমধ্যেই হেসে ওঠে কুমারী। ফটাফট উঠতে থাকে তার ফোক্‌লা ক্যানডিড্‌ শ্বেতবসনার বনেদী আতিথ্যের আশকারায়। আটপৌরে করে সাদা থান পরা বৃদ্ধার হাতে চওড়া কালো কাপড়ের ব্যান্ডের ঘড়ি, কাঁধছাড়ানো সুবিন্যস্ত ঘন সাদা চুল। সজাগ, সপ্রতিভ, এমন কি স্টাইলিশ। পোর্ট্রেট তুলতে চাওয়াটাও নিতান্তই বেয়াদবি হয়ে যাবে ব’লে শুধু মুগ্ধচোখে দেখে গেলাম। নিজের গদগদ ভাবটা প্রকাশ করব ভেবেও সামলে নিলাম। বলা যায় না, যদি...? তাঁর হাতের ঘড়িটাই যে বাড়ীর পুজোকে বেঁধে রেখেছে নির্ঘন্টের সঙ্গে, তা খুব পরিষ্কার। উঠোনে বসা কিশোর ঢাকী অবাক চোখে দেখে যায় শহুরে দাদা-দিদিদের কান্ডকারখানা। কি এত ধরে রাখতে চাইছে এরা ক্যামেরায়? কি খুঁজে চলেছে খালি খালি? কি পালিয়ে যাবে ছবি না তুললে?
কাছাকাছি ঘোষালবাড়ীতে বা কলুটোলা স্ট্রীটে মতিলাল শীলের বাড়ীতেও মোটামুটি এক দৃশ্য। সক্কাল সক্কাল কূলধর্মরক্ষার্থে হাজির বাড়ীর ক’জন মহিলা, পুরোহিত, আর ঢাকী। অঞ্জলির ফুলের টানাটানি নেই, চটি হারাবার ভয় নেই, মাইক নেই।
কাঁসর বেজে ওঠে, ঢাকে কাঠি পড়ে। শুরু হয় কুমারীপুজো। কাঁসর থামলেই পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ আর নেপথ্যে উঠোনে ঘুরপাক খাওয়া পায়রার বকমবকম, আর দোতলা থেকে লম্বা করে শুকোতে দেওয়া শাড়ীর লটরপটর

ঠাকুরদেখা-মাঝরাতের সন্ধিপুজো-রিহার্সাল-হইহই... হুড়মুড়িয়ে ক’দিনের জমা ক্লান্তি ঘুম হয়ে দেখা দেয় দশমীর দুপুরে। যতক্ষণে অতিপরিচিত কন্ঠস্বরে বিসর্জনের আয়োজনের খবর মাইকের কল্যাণে ভেসে আসে কানে, খুব দেরী হয়ে গেছে। এবার আর হ’ল না। স্কার্ট-টপেই নেমে যাই। কখনও শাঁখ বাজাই, কখনও তুলি ছবি। ভাবছি বরণের ছবি তোলা ফস্কালেও অন্ততঃ লালমুখো হওয়া থেকে বাঁচা গেল। এমন সময় এগিয়ে আসে একটা লাল হাত, তারপর আরেকটা। আরো একটা... চোখ বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ মনে পড়ে যায় বসুমল্লিকবাড়ীর দুর্গার মুখ। কে এসেছে এখন তার বিদায়বেলায়? বাড়ির ক’জনেই হয়ত শান্ত বিদায় জানাচ্ছে তাঁকে। হয়ত বনেদী বাড়ীর সিঁদুরখেলার ছবি তুলতে চলে এসেছেন ফটোগ্রাফাররা। অদেখা ছবি উঠতে থাকে মাথার মধ্যে। হয়ত এসব মুহূর্তের রহস্য আর রহস্য থাকতে দেবে না ফেসবুক। কে জানে। ভাল লাগে না। মানসক্যামেরায় কি ধরে রাখতে চাইছি আমি? কি পালিয়ে যাবে ওই ছবিটা বদলে গেলে? সত্যি ছবি কোনটা? কে জানে। ক’দিন বাদে আমিও তো যাব বাড়ীর থেকে বাড়ী।

TEXT © DURBA BASU

No comments: